গল্প: লাল জামাটা

লেখক: আবু হোরায়রা ফাহিম

“অাং‌কেল,কয়ডা চাইল দেন না!””কাল‌কে যে চাইল নি‌লি,ট্যাকা কই?””কালকা অ‌নেক বৃ‌ষ্টি হই‌ছিল,হেল্লাইগা ফুল বেচ‌তে পা‌রি নাই।ইনকামও হয় নাই।“”তাই‌লে অা‌মি কি করুম!ট্যাকা ছাড়া অার চাইল দিওন যাইব না।অা‌গে ট্যাকা দে,‌হেরপ‌রে চাইল নিস।”মন খারাপ ক‌রে ফি‌রে এলো কুসুম।বা‌ড়ি‌তে চাল নেই,তাই ভাত খাওয়াটা হয়‌তো হ‌বে না অাজ।রাস্তার পা‌শের টং দোকানের চা অার রু‌টিটাই অাজ ভরসা।

কুসু‌মের মা-বাবা নেই।দুঃসম্প‌র্কের এক চাচার কা‌ছেই তার মানুষ হওয়া।চাচা পঙ্গু।‌বি‌য়ে করে‌ছেন অ‌নেক‌ অা‌গে।ত‌বে তা‌দের কো‌নো সন্তান হয়‌নি।তাই তি‌নি কুসুম‌কে নি‌জের‌ মে‌য়ের মত ভা‌লোবা‌সেন।তি‌নি পঙ্গু হওয়ায় রোজগার কর‌তে পা‌রেন না।পে‌টের দা‌য়ে ভিক্ষা ক‌রেই জীবন চালান।ত‌বে কুসু‌মের চাচী কো‌নো এক বি‌চিত্র কার‌ণে কুসুম‌কে পছন্দ ক‌রেন না।

পর‌দিন সকাল‌বেলায়ই ফুল কিন‌তে গি‌য়ে‌ছে কুসুম।অাজ অাটটা গোলাপ অার রজনীগন্ধ্যা কি‌নে‌ছে।অার টাকা নেই তার কা‌ছে।এগু‌লো বি‌ক্রি ক‌রেই দুপুরে খে‌তে হ‌বে।”ভাইজান,দুইটা গোলাপ নেন।‌বিশ ট্যাকা,‌নেন না ভাইজান।”এক গা‌ড়ির খোলা জানালার প‌া‌শে দা‌ড়ি‌য়ে কথাগু‌লো বল‌ছি‌ল কুসুম।”ধুর!এই সকাল‌বেলা ছে‌ড়ি চিল্লায় ক্যা!যা এহান থেইকা!”‌লোকটা জানালার গ্লাস উ‌ঠি‌য়ে চ‌লে গেল।

কুসু‌মের সা‌থে প্র‌তি‌দিনই এমনটা হয়।এই শি‌ক্ষিত শ্রে‌ণির মানুষগু‌লোর এমন অাচর‌ণে ও অবাক হয়।মানু‌ষের মন থে‌কে ভা‌লোবাসা নামক ব্যাপারটা উ‌ঠে গে‌ছে।ফু‌লের মত অসাধারণ জি‌নিস কেনার সামর্থ্য তা‌দের নেই।কারণ,এর জন্য বড় ম‌নের অ‌ধিকারী হ‌তে হয়।কিন্তু এই শি‌ক্ষিত লোকগু‌লোর সেই মন নেই।

দুপু‌রের দি‌কে বা‌ড়ি ফি‌রে অা‌সে কুসুম।শাপলা তরকা‌রি অার কাঁচা ম‌রিচ দি‌য়ে দুপু‌রের খাবারটা সে‌রে নেয়।শাপলা তরকা‌রিটা তার ভা‌লোলা‌গে।চাচী যা‌দের বা‌ড়ি‌তে কাজ ক‌রে,তারা মা‌ঝে মা‌ঝে মুর‌গির গলা-ক‌লিজা এসব দেয়।কুসু‌মের এ‌সব খে‌তে ভাল্লা‌গেনা।চাচী কিছুক্ষণ অা‌গে মাত্র কাজ থে‌কে এ‌লেন।‌কিছুটা রাগী স্বভা‌বের মানুষ চাচী।‌কিছুটা না ব‌লে,অ‌নেক বলাই ভা‌লো।‌কো‌নো কিছু হ‌লে কুসুম‌কে মা‌রেন,গালমন্দ ক‌রেন।মা‌ঝে মা‌ঝে মারেনও ব‌টে।তারপরও কুসুম চাচী‌কে ভীষণ ভা‌লোবা‌সে।

খাওয়া শেষ ক‌রে বাসন ধুয়ে রান্নাঘ‌রে রাখল কুসুম।চাচা তখন বাসায় ফি‌রে‌ তা‌কে ডাক দি‌লেন,”মা‌ রে,একটু ভাত দে তো মা,অ‌নেক খিদা লাগ‌সে।”কুসুম দ্রুত ভাত অার তরকা‌রি এ‌নে চাচাকে খে‌তে দিল।

বি‌কেল বেলা বাই‌রে বের হল কুসুম।‌বের হওয়া বল‌তে,ওর বান্ধবীর সা‌থে খেল‌তে গেল।ও‌দের ব‌স্তির সব বাচ্চারা একসা‌থে খে‌লে।সুমনা,ঝর্ণা অার গী‌তা ওর সব‌চে‌য়ে কা‌ছের বান্ধবী।ও‌দের স‌ঙ্গে দারুণ সময় কাটায় কুসুম।অাজ বৌ‌চি খেল‌ছে ওরা।কুসুম বউ হওয়ায় দাগকাটা ঘ‌রের ভেতর ব‌সে অাছে।অন্যরা দা‌গের বাই‌রে দৌড়া‌চ্ছে।একজনকে ধর‌তে সবাই দৌড়া‌চ্ছে।এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য।প্রকৃ‌তিও হা‌স্যোজ্জল দৃ‌ষ্টি‌তে তা‌কি‌য়ে অা‌ছে তা‌দের দি‌কে।এভাবেই সুন্দর দিনটার সূর্যাস্ত ঘটল।

কুসুম বা‌ড়ি ফির‌ছে।রাস্তার পা‌শেই একটা কাপ‌ড়ের দোকান।কাঁচ দি‌য়ে ঘেরা।‌দেখ‌তে কি যে সুন্দর!কুসুম তা‌কি‌য়ে তা‌কি‌য়ে বাই‌রে থে‌কে দেখ‌ছে সেসব।হঠাৎ এক জামার দি‌কে চোখ অাট‌কে যায় কুসু‌মের।কুসুম পড়‌তে জা‌নে না।‌সে দা‌রোয়ানকে বলল,”অাং‌কেল,এটার দাম কত?””১৫০০ টাকা,‌লেখাই‌তো অা‌ছে,‌চ‌ক্ষে দেহস না?”কুসুম মন খারাপ ক‌রে বা‌ড়ি ফি‌রে এল।‌সে ভাব‌তে লাগল,সবাই কেন এমন?‌কেন এমন ক‌রে সবাই?‌কেউ কি একটু সুন্দরভা‌বে কথা বল‌তে পা‌রে না ওর সা‌থে?উত্তর পায় না সে।লাল জামাটার কথা ভাব‌তে ভাব‌তেই ঘু‌মের রা‌জ্যে ত‌লি‌য়ে গেল সে।

সকাল হ‌তেই ফুল কিন‌তে চ‌লে গেল কুসুম।তারপর নিত্যকার রু‌টিন।ত‌বে অাজ ফুল বি‌ক্রি ক‌রে বেশ লাভ হল তার।হঠাৎ তার মাথায় একটা বু‌দ্ধি এ‌লো।সে য‌দি প্রতি‌দি‌নের টাকা থে‌কে কিছু টাকা জ‌মি‌য়ে রা‌খে ত‌বে সে লাল জামাটা কিনতে পার‌বে।সে সা‌থে চাচার জন্য একটা লুঙ্গি কিন‌বে।পুর‌নো লু‌ঙ্গিটা ছি‌ড়ে গে‌ছে অ‌নেক‌দিন হ‌য়ে‌ছে।চাচীর জন্য একটা পা‌নের বাটা কেনা দরকার।চাচী‌কে দি‌লে নিশ্চয়ই চাচী অার রাগ কর‌বে না।বরং ও‌কে ভীষণ অাদর কর‌বে।কথাগু‌লো ভাব‌তেই কুসু‌মের মনটা ভা‌লো হ‌য়ে গেল।

৬ মাস পর

ফুল বি‌ক্রি ক‌রে ২০০০ টাকা জ‌মি‌য়ে‌ছে কুসুম।সে ঠিক করল অাজ লাল জামাটা সে কি‌নেই ফেল‌বে।‌ভেত‌রে ভীষণ অানন্দ অার উ‌ত্তেজনা কাজ কর‌ছে।‌সন্ধ্যায় খেলাশে‌ষে টাকাটা নি‌য়ে বের হল কুসুম।প্রথ‌মে কাঁচে ঘেরা সুন্দর দোকানটা থে‌কে তার প্রিয় লাল জামাটা কিনল সে।তা‌কে দেখ‌তে পরীর মত লাগ‌ছিল তখন।তারপর বড় মা‌র্কেটটা থেকে চাচার জন্য লু‌ঙ্গি অার চাচীর জন্য পা‌নের বাটাটা কিনল।অাজ কুসুম সব‌চে‌য়ে বে‌শি খু‌শি।এতটা অানন্দ তার কখ‌নো হয়‌নি।প্রাণ খু‌লে হাস‌ছে অাজ।তৃ‌প্তির হা‌সি,অর্জ‌নের হা‌সি।

‌কেনা‌কাটা শেষ ক‌রে বা‌ড়ির পথ ধরল কুসুম।মাঝখানে একটা সরু গ‌লি।গ‌লিটা বেশ অন্ধকার।কিন্তু কুসু‌মের হাট‌তে ভয় ক‌রে না।ম‌নের অান‌ন্দে হে‌টে যা‌চ্ছে সে।হঠাৎ পেছন থে‌কে কাঁধে একটা হা‌তের স্পর্শ অনুভব করল কুসুম।এরপর অা‌রো দু‌টো।কুসুম ভয় পে‌য়ে গেল।এরা ভূত নয়,‌হিংস্র কো‌নো প্রা‌ণি নয়,এরা মানুষ।তিনজন লোক প্রথ‌মে কুসুম‌কে জাপ‌টে ধরল,তারপর ঘৃণ্য হিংস্রতায় গ্রাস করল কুসু‌মের ছোট্ট শরীরটাকে।শে‌ষে তার গলাটা ভীষণ জো‌রে চে‌পে ধরল তারা।কুসু‌মের খুব কষ্ট হ‌চ্ছিল।বারবার তা‌দের কা‌ছে ক্ষমা চাই‌ছিল সে।‌কিন্তু তারা তা‌কে ক্ষমা ক‌রে‌নি।ভীষণ নিষ্ঠুরতা অার পাশ‌বিকতায় মৃত্যু হয় কুসু‌মের।

কুসু‌মের লাল জামাটা রক্তাক্ত হ‌য়ে প‌ড়ে অা‌ছে।তার লাশটা বু‌ড়িগঙ্গায় ফে‌লে দিল সেই তিন হিংস্র প্রা‌ণি।ফুটফু‌টে সুন্দর এই মে‌য়েটার দে‌হের অা‌রেক নাম হ‌য়ে গেল লাশ।অার কখ‌নো সে রাস্তায় দা‌ড়ি‌য়ে ফুল বি‌ক্রি কর‌বে না,গোধূ‌লি‌বেলায় খেলায় মে‌তে উঠ‌বে না,লাল জামাটা পাওয়ার অান‌ন্দে নে‌চে উঠ‌বে না।তার ছিন্ন‌ভিন্ন নিথর দেহটাই অাজ তার শেষ অ‌স্তিত্বের প্রমাণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

x

Check Also

নবীজি (সঃ)

যে কারনে নিত্যপণ্যের ওপর ভ্যাট কমাতে নির্দেশ দিলে প্রধানমন্ত্রী

নারায়ণগঞ্জ বাণী২৪.কমঃ নিত্যপণ্যের ওপর ভ্যাট কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নির্দেশনা আমদানি ক্ষেত্রেও পযোজ্য হবে। দেশে নিত্যপণ্যের দাম আকাশ চুম্বি।